কুসংস্কার
কুসংস্কার হচ্ছে মানুষের যুক্তি-বিচারহীন অন্ধবিশ্বাস যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Superstition। কুসংস্কার টিকে থাকে শুধুমাত্র মানুষের বিশ্বাসের কারণে। এই যুক্তি-বিচারহীন অন্ধবিশ্বাস হতে পারে ধর্মের নামে বা সামাজিকতার নামে অথবা মতবাদ ও শাস্ত্রের নামে।
এই কুসংস্কারজনিত অন্ধ বিশ্বাস আমাদের সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে।সাধারণত গ্রামীণ লোকাচারে এই ধরনের বিশ্বাসজাত কুসংস্কার বেশি দেখা গেলেও শহুরে লোকজন যে এসব থেকে মুক্ত তা বলা যাবে না।সমাজে ছড়িয়ে থাকা এসব কুসংস্কারসমূহের মধ্যে কিছু কুসংস্কারের কথা তুলে ধরা হলো-
- মাজারের ক্ষমতা আছে ধারণা করা।
- বাচ্চাদের কপালে ফোটা না দিলে নজর লেগে যাবে।
- মাথায় গীট যত হবে বিয়ে তত হবে।
- তাবিজ ঝুলালে রোগ কমে যাবে।
- কোনো স্ত্রী যদি হাতে চুড়ি না পড়ে তাহলে স্বামীর আয়ু কমে যাবে।
- পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পূর্বে ডিম খেতে নেই, নাহলে পরীক্ষায় ডিম (শূন্য) পাবে।
- খাবার খাওয়ার সময় সালাম দিতে নেই।
- দোকানের প্রথম কাস্টমার কখনও ফেরত দিতে নেই।
- জোড়া কলা খেলে জোড়া সন্তানের জন্ম হবে।
- রাতে নখ, চুল ইত্যাদি কাটতে নেই।
- ঘর থেকে কোন উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর পেছন থেকে কেউ ডাক দিলে যাত্রা অশুভ হবে।
- যদি ব্যাঙ ডাকে তাহলে বৃষ্টি হবে।
- কুরআন মাজীদ যদি হাত থেকে পড়ে যায় তাহলে আড়াই কেজি চাল দিতে হবে।
- বাচ্চাদের দাঁত পড়লে সেই দাঁত ইঁদুরের গর্তে ফেললে সুন্দর দাঁত উঠে।
- কেউ একজনের কথা বলার সময় সে যদি সেখানে উপস্থিত হয়ে যায় তাকে দেখে বলা- আপনার কথাই হচ্ছিলো আপনি অনেকদিন বাঁচবেন।
- কোন বিশেষ পাখি ডাকলে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসবে মনে করা।
- বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় খালি কলস ,কালো বিড়াল, ঝাড়ু ইত্যাদি দেখলে যাত্রা অশুভ হবে মনে করা।
- খাবার খাওয়ার সময় হেচকি উঠলে কেউ স্মরণ করছে মনে করা।
- বৃষ্টির সময় রোদ দেখা দিলে শিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।
- বাসর ঘরে স্ত্রীকে দেন-মোহর না দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেই চলে, দিতে হয় না।
- খালি মুখে মেহমান ফেরত যেতে নেই, অমংগল হয়, কাউকে শুধু পানি দেয়া উচিত না।
- রাতে গাছ থেকে ফল পাড়া উচিত নয় ।
- রাতে গাছের পাতা ছিঁড়া ঠিক না।
- বিধবা নারীকে সাদা শাড়ি পরিধান করতে হয়।
- ভাঙ্গা আয়না দিয়ে নিজের চেহারা দেখা যাবে না।
- ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসবে আর বাম হাতের তালু চুলকালে বিপদ আসবে।
- গর্ভবতী নারী কিছু কাটা-কাটি বা জবেহ করতে পারবে না।
- বাচ্চাদের শরীরে লোহা বা তাবিজ থাকতে হবে।
- কাউকে রুমাল দিলে ঝগড়া হয়।
- হোঁচট খেলে ভাগ্যে দুর্ভোগ আছে মনে করা।
- হাত থেকে প্লেট পড়ে গেলে ঘরে মেহমান আসবে।
- নতুন স্ত্রী কোন ভাল কাজ করলে তা শুভ লক্ষণ।
- রাতে কাক অথবা কুকুর ডাকলে বিপদ আসবে।
- কাউকে ধর্মের ভাই-বোন, বাবা-মা ডাকলেই তারা আপন হয়ে যায়, পর্দা লাগে না।
- একজন অন্য জনের মাথায় একবার টোকা খেলে দ্বিতীয় বার টোকা দিতে হবে নতুবা মাথায় শিং উঠবে।
- পোড়া খানা খেলে, পিপড়া বা জল পোকা খেলে সাতার শিখবে।
- সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘর ঝাড় দেয়ার পূর্বে কাউকে কোন কিছু দেয়া যাবে না।
- রাতে কোন লেন-দেন করা যাবে না।
- সকালে দোকান খুলে বনি না করে কাউকে বাকী দেয়া যাবে না।
- দাঁড়ী-পাল্লা পায়ে লাগলে বা হাত থেকে নিচে পড়ে গেলে সালাম করতে হয়।
- শুকরের নাম মুখে নিলে মুখ ৪০দিন পর্যন্ত নাপাক থাকে।
কুসংস্কার ও ইসলাম
আমাদের আলোকিত ধর্ম ইসলামের প্রধান শিক্ষা হলো ঈমান। আর ঈমানের বিপরীত হচ্ছে কুফর। ঈমান হচ্ছে আলো পক্ষান্তরে কুফর হচ্ছে অন্ধকার। সুতরাং কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে ঈমানের আলোর দিকে আসতে হবে। ঈমানের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো ‘তাওহিদ’। তাওহিদের বিপরীত হচ্ছে শিরক। সুতরাং, অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে তাওহিদের আলোই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে প্রচলিত এই কুসংস্কারগুলোর প্রতি বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য মারাত্মক হুমকি, এর মধ্যে কিছু কিছু কুসংস্কারতো স্পষ্ট শিরক এবং জাহেলিয়াত। ইসলামে শিরক হচ্ছে একটি ভয়াবহ কবিরা গোনাহ। আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকে শরিক করার নামই শিরক। আর এই কুসংস্কারের মাধ্যমে মানুষ সরাসরি শিরকে লিপ্ত হচ্ছে ।
মহান আল্লাহ তা'য়ালা ও প্রিয় রাসূল (স) এই কুসংস্কারজনিত বিশ্বাসকে হারাম বলে অভিহিত করেছেন। সকল মঙ্গল-অমঙ্গলের শক্তি ও ক্ষমতার মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ তা'য়ালা। এই ঈমান ও বিশ্বাসের প্রতি প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের সুদৃঢ় আস্থা থাকতে হবে। মেশকাত শরীফে উল্লেখ আছে- রাসূল (স) বলেছেন,
শুভাশুভ লক্ষণ ও দিনক্ষণ ঠিক করা এবং কুসংস্কারজনিত অন্ধ বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা বা বিচার করা শেরেকি পৌত্তলিকতার পর্যায়ভুক্ত।
আবু দাউদ শরীফে উল্লেখ আছে, অশুভ লক্ষণ মানা শিরক, রাসূলে পাক (স) একথা তিনবার উচ্চারণ করেছেন। মেশকাত শরীফে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে,
এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (স), আমরা এক বাড়িতে অবস্থান করতাম। সেখানে আমাদের সন্তান-সন্তুতি ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছিলো, অতঃপর আর এক বাড়িতে গেলাম, সেখানে আমাদের সন্তান-সন্তুতি ও ধন-সম্পদ হ্রাস পেলো। রাসূল (স) একে অস্বস্থিকর জায়গা বলে অভিহিত করেন।
কুসংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন করা, কোনো কিছুকে কুলক্ষণ ভাবা বা তার প্রতি আস্থাশীল হওয়াও পাপ। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে যে, গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত হতে অনেক দূরে অবস্থান করবে। কারণ তারা আল্লাহ রাসূলের নীতি আদর্শ বিরোধী অলীক ধ্যান-ধারণার মোহতাজে গ্রেফতার হয়ে আছে।
রাসূল (স) এর আগমন-পূর্ব সময়কে কুরআনুল কারিমে ‘আইয়্যামে জাহিলিয়াত’ বা অজ্ঞতা, ববর্রতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগ বলা হয়েছে। কারণ, তৎকালীন আরব সমাজ ছিলো নানা কুসংস্কারের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে মহান আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের রাসূল (স) কে পাঠিয়ে ঘোষণা দেন যে,
তিনি সেই সত্তা, যিনি স্বীয় রাসুলকে সঠিক পথ ও সঠিক তথা সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব মতবাদের ওপর এ ধর্ম তথা মতবাদ বিজয়ী হতে পারে। (সুরা আত তাওবা : ৩৩)।আমাদের রাসূল (স) অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে ঘোর অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব সমাজে বিদ্যমান যাবতীয় কুসংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করে সে সমাজে ইসলামের জ্যোতি বিকীরণ করেন। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই সমাজ থেকে যাবতীয় কুসংস্কার কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি নবুয়ত প্রাপ্তির পর তার দাওয়াতি কাজের সূচনায় জাহেলি যুগের সব কুসংস্কারকে পরিহার করে এক আল্লাহর আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলেন। ফলে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে কুসংস্কারের প্রভাব কমতে থাকে। এ অবস্থায় নবুয়ত প্রাপ্ত হয়ে তিনি ইসলামের প্রচার করতে থাকেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুমিনদের মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন,
হে মুমিনরা! মদ, জুয়া ও মূর্তিপূজার বেদি এবং ভাগ্য নির্ণয়কারী শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (সুরা মায়িদা : ৯০)।কুসংস্কারজনিত অন্ধবিশ্বাসে পড়ে মানুষ তার নিজের ঈমানকে দুর্বল করে তুলছে। বস্তুত মুসলমানের জন্য মহান আল্লাহর ওপর ভরসাই যথেষ্ট। ইসলামি শরিয়ত পরিপন্থি প্রচলিত এসব বিশ্বাস বর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য। তাছাড়া কুসংস্কার বন্ধের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানো আমাদের সবার ঈমানি দায়িত্ব। কুসংস্কার প্রসঙ্গে রাসূল (স) বলেছেন,
অশুভ বা কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই, বরং তা শুভ বলে মনে করা ভালো। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শুভ লক্ষণ কী? তিনি বললেন, এরূপ অর্থবোধক কথা, যা তোমাদের কেউ শুনতে পায়। (বোখারি শরিফ)।রাসূল (স) জাহেলি যুগের সব কুপ্রথার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন,
জাহেলি যুগের সব কুপ্রথা আমার পায়ের নিচে নিক্ষেপ করা হলো।মানবজাতিকে সর্ববিধ অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যই কুরআনের আগমন। মহান আল্লাহ কত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন,
এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যেন তুমি মানুষকে বের করে আনো (অনেক) অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে। [সুরা ইবরাহিম (১৪) : ০১]আলোর স্রষ্টা মহান আল্লাহ তা'য়ালা যেনো আমাদের সব অন্ধকার থেকে মুক্তিদান করেন এই প্রার্থনা।
0 Comments